০৩/০১/২০১৮
ঢাকা
পিতার কাছে খোলা চিঠি : একবিংশ শতাব্দীর এই ডিজিটাল যুগে মোবাইলের এসএমএস চিঠির আবেদনকে পুড়িয়ে ফেললেও আমার কাছে এর আবেদন এখনও রয়ে গেছে। কেননা, চিঠির সাথে প্রেরকের গায়ের ঘ্রাণ মিশে থাকে- এসএমএস এর সাথে নয়। আর এখন তোমাকে যা বলব এবং যেভাবে বলব, তা প্রকাশের এ মাধ্যম ছাড়া আমার আর কোন উপায় জানা নাই।
আমি টেনশন কমাব কীভাবে? আমার সে উপায় নেই। আমার ভাই-বোন একটা এক এক জায়গায় থাকে। বাপ-মা, যারা এত কষ্ট করে বড় করে তুলেছে, এই কনকনে শীতে একা থাকে। কী খায়, কখন খায়- জানি না। জানতে পারি না। মোবাইলে একবার ‘হ্যালো’ বলে – তোমরা কেমন আছ- বললেই কী সব দায়িত্ব পালন করা হয়ে যায়! এটা এক ধরণের প্রতারণা! পারিবারিক বন্ধন, বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার মাধ্যম হচ্ছে এই ‘হ্যালো’।
আমি যখন এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাই, আমি গোপনে শুনেছি যে, আমার বাবা আমার মা’কে বলছে, জিয়ার মা, টাকার অভাবে আমি আমার সোনামনিকে ভাল কিছু খাওয়তে পারি না। ভাল কোন জামা কিনে দিতে পারি না।’ আমি তখন বুঝিনি এ কথার মানে। এখন বুঝি। অংশী যখন কিছু চায়। আমার দীর্ঘ অতীতের কথা মনে পড়ে। দুই জেনারেশনের মাঝে পড়ে ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খাচ্ছি। আমার মনে আছে- একজোড়া জুতো চেয়েছিলাম আব্বার কাছে। দিতে পারেন নাই। এখন আমি কারও কারও এক মাসের সমান বেতনের সমমূল্যের জুতো পায়ে দিই। আমি কিছু খেতে গেলে মনে পড়ে আমার বাপ-মা কী খাচ্ছ; জামা-কাপড় কিনতে গেলে মনে পড়ে। আমি কই যাব? একদিন সিলেটে একটা সেমিনারে বক্তৃতা দেয়া শেষে হোটেলে খেতে গিয়ে খাবারের মধ্যে বাপ-মায়ের মুখ দেখি। আমি না খেয়ে বিল মিটিয়ে চলে আসি।
বাপ-মা এর সঙ্গা কী? তোমার স্যার তো নতুন করে সঙ্গা তৈরি করছে। এই যে আমাকে সব সময় একটা টেনশনের মধ্যে রেখে লক্ষীপাশার জমিদারী পাহারা দিচ্ছে এটা যেন তার বিবেকের তাড়না না হয়ে যায়, নিজের কাছে অপরাধী করে না তোলে। যদি এমন হয় যে, আমার অকাল মৃতদেহ তাকে ঘাড়ে করে নিয়ে কবরে রাখতে হচ্ছে, তাহলে যে আত্মঅহংকারের ক্রুশে সে বিদ্ধ হয়ে আছে, সেখানেও মুখ দেখাতে পারবে না। আমার মেয়েটো হবে এতিমের এতিম। যে বয়সে তার দাদা-দাদীর ঘাড়ে চড়ে বেড়ানোর কথা সে বয়সে সে জানালার শিক ধরে বাইরে তাকিয়ে থাকে। এটাকেও ভবিতব্য মেনে নিয়েছি। যেখানে এই অত্যাধুনিক যুগে পিতা-মাতা হয়ে যায় অতিরিক্ত, অনাহুত; সেখানে তাদেরকে আমি আমার র্সবোচ্চ ক্ষমতা দিয়ে রাজার হালে রাখতে চাচ্ছি আর তারা করছে কী- নিজেদের চারপাশে এমন একটা আবহ তৈরি করে রেখেছে যে, তাদের কেউ নেই – তারা একা। লক্ষ্মীপাশা থেকে ঢাকা- দুরত্ব খুব বেশি নয়। প্রতিমাসে একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকা বাপ-মা কে পাঠিয়ে দেয়ার নাম দায়িত্ব বা কর্তব্য নয়, ভণ্ডামী, স্রেফ ভাওতাবাজী- লোক দেখানো। বাপ-মায়ের সাথে ছেলে-মেয়ের সর্ম্পক ভন্ডামীর নয়, ভালবাসার। এক জনের হাতে সূচ ফুটলে অন্যের বুকে রক্ত ক্ষরণ হয়। দূরে থেকে আমার জন্য লোক দেখানো দোয়া করার কোন প্রয়োজন নাই; বরং পারলে আমার কাছে থেকে সবকিছুর অংশীদার হোক। আমি বনের রাজা ওসমান গণি হতে চাই না, আমি আমার বাপ-মায়ের সেবা করতে চাই। বিনিময়ে আমাকে কিছু দিতে হবে না। দোয়াও করতে হবে না। আমি নিজের কাছে সৎ থাকলেই আমার চলবে।
আমার সারাজীবনরে স্বপ্ন ছিল যে, আমি একজন রাইটার হব। সবাই আমাকে এক নামে চিনবে। মানুষ আমাকে তাদের ভরসার স্থল হিসেবে জানবে। আমি একটু একটু করে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এই ৮/৯তারিখে আমার প্রথম বই বাজারে আসতে যাচ্ছে। ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। বইখানার মোড়ক উন্মোচন হবে। আমি চাই আমার বাপ-মায়ের উপস্থিতি। এটা কি আমার অন্যায় বা খুব বেশি চাওয়া হয়ে গেছে! যদি বেশিই হয়ে থাকে, তাহলে আমার আর কিছুই বলার নাই। হাশরের ময়দানে ছেলের প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য বাপ যেন প্রস্তুত হয়ে থাকে।
পুত্র
[পুত্রের চিঠি পেয়ে পিতা রওয়ানা দিয়েছে ঢাকার পথে]